শেখ মুজিবুর রহমানের বঙ্গবন্ধু ও জাতির পিতা হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে যে মানুষটির অবদান সবচেয়ে বেশি, তিনি তার স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন নেছা। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও অনেকবার শেখ ফজিলাতুন নেছার কথা উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাও বিভিন্ন সময়ে দেয়া বক্তব্যে বঙ্গবন্ধুর পেছনে অনুপ্রেরণাদায়ী হিসেবে শেখ ফজিলাতুন নেছার কথা তুলে ধরেছেন।
শেখ ফজিলাতুন নেছা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩০ সালের এই দিন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। তার ডাকনাম ছিল রেণু। পিতা শেখ জহুরুল হক ও মাতা হোসনে আরা বেগম।
রেণুর বয়স যখন ৫, তখনই পিতা-মাতাকে হারান তিনি। তার পিতা শেখ জহুরুল হক ছিলেন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর চাচা। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যখন রেণুর বিয়ে হয়, তখন তার বয়স ছিল মাত্র তিন বছর।
বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও বিয়ের ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘একটা ঘটনা লেখা দরকার, নিশ্চয়ই অনেকে আশ্চর্য হবেন। আমার যখন বিবাহ হয়, তখন আমার বয়স বারো-তেরো বছর হতে পারে। রেণুর বাবা মারা যাবার পরে ওর দাদা আমার আব্বাকে ডেকে বললেন যে, আমার সাথে তার এক নাতনির বিবাহ দিতে হবে। কারণ তিনি তাঁর সমস্ত সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাবেন।
‘রেণুর দাদা আমার আব্বার চাচা। মুরব্বির হুকুম মানার জন্যই রেণুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে। তখন কিছুই বুঝতাম না, রেণুর বয়স তখন বোধ হয় তিন বছর হবে। রেণুর যখন পাঁচ বছর বয়স, তখন তার মা হোসনে আরা বেগম মারা যান। একমাত্র রইল তার দাদা। রেণুর সাত বছর বয়সে দাদাও মারা যান। তারপর সে আমার মায়ের কাছে চলে আসে। রেণুদের ঘর আমার ঘর পাশাপাশি ছিল, মধ্যে মাত্র দুই হাত ব্যবধান।’
বঙ্গবন্ধু রাজনীতির কারণে জীবনের একটি বড় সময় কাটিয়েছেন কারাগারে। তিনি কারাগারে থাকার সময় সংগঠনের বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করতেন শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবই। এ কথা বিভিন্ন সময় বক্তব্যে তুলে ধরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কালে একাত্তরের ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণের ঠিক আগ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু যখন কী বলবেন তা নিয়ে সংশয়ে ছিলেন। তখন তাকে সাহস জুগিয়েছিলেন শেখ ফজিলাতুন নেছাই।
সেদিন বেগম মুজিব বলেছিলেন, ‘সারা জীবন তুমি সংগ্রাম করেছো, তুমি জেল-জুলুম অত্যাচার সহ্য করেছো। তুমি জানো যে এ দেশের মানুষের জন্য কী চাই, তোমার থেকে বেশি কেউ জানে না। তোমার মনে যে কথা আসবে, তুমি শুধু সেই কথাই বলবে, কারো কথা শুনতে হবে না।’
এর পরই বঙ্গবন্ধু তার ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ মন্ত্র উচ্চারণ করেন, যার ফলে পরবর্তী সময়ে আসে বঞ্চনা থেকে মুক্তি।
বেগম মুজিব একদিকে যেমন ছিলেন একজন প্রেমময়ী স্ত্রী, ত্যাগী ও আদর্শ মাতা, অন্যদিকে ছিলেন একজন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদও। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই তার পাশে থেকেছেন বেগম মুজিব। স্বামীকে খুব বেশি সময় কাছে না পেলেও এর জন্য কোনো অনুযোগ-অভিযোগ ছিল না তার; বরং একাই শক্ত হাতে সামলেছেন সংসার।
একদিকে সন্তানদের সামলে রাখা, অন্যদিকে কারাগারে গিয়ে স্বামীর মনোবল দৃঢ় করা কিংবা আইনজীবীর কাছে মামলার খোঁজখবর করা—সবকিছু করেছেন এক হাতে। এত বড় নেতার স্ত্রী হয়েও ছিলেন মাটির কাছাকাছি, খুবই সাধারণ একজন মানুষ।
ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধুকে প্রায়ই থাকতে হয়েছে কারাগারে। এ সময় গোয়েন্দা নজরদারি এড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর বার্তা ঠিকই দলের নেতা-কর্মীদের পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। আড়ালে থেকে সংগঠিত করেছেন মানুষকে; জুগিয়েছেন সাহস।
একাত্তরের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরেই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসা থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। সে সময় গ্রেপ্তার হন শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবও। তখন তার সঙ্গে ছিলেন শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল। তাদের বন্দি রাখা হয় ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডের একটি বাসায়।
পরবর্তী সময়ে শেখ জামাল পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয়ের পরের দিন যৌথবাহিনী তাদের সেখান থেকে মুক্ত করে।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যেমন জাতির পিতা পরিচয় লাভ করেন, তেমনি প্রেরণাদায়ী হিসেবে ‘বঙ্গমাতা’ পরিচয় লাভ করেন শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। স্বাধীনতার পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বামীর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে পেছন থেকে অনুপ্রেরণা দিয়ে গেছেন মহীয়সী এ নারী।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসায় ঘাতকদের হাতে বঙ্গবন্ধু ও পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে নিহত হন তিনিও।
বঙ্গমাতার জন্মদিনে সকাল ৯টায় বনানী কবরস্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা।